রান্নার বিভিন্ন পদ্ধতি

মানুষ প্রথম যখন রান্না করতে শেখে তখন তারা শুধু মাত্র খাদ্য বস্তুকে আগুণে পুড়িয়ে বা ঝলসিয়ে খেত। কিন্তু মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের সাথে সাথে তারা বিভিন্ন পদ্ধতিতে খাদ্য তৈরির করতে শেখে। এখানে খাদ্য প্রস্তুতের মৌলিক বিষয়গুলো তুলে ধরা হল।

* সিদ্ধ: রান্নার আদি এবং প্রাথমিক পদ্ধতি এটি। মূলত অধিকাংশ খাবার প্রস্তুতের প্রাথমিক পর্যায়ে এই কাজটি করতে হয়। শাক-সবজি, ভাত-মাছ, মাংস, ডাল ইত্যাদি খাদ্যবস্তু পানি অথবা অন্য কোন তরল পদার্থে ফুটিয়ে সিদ্ধ করে রান্না করা হয়। এটাই রান্নার সহজ এবং সাধারণ পদ্ধতি। দৈনন্দিন রান্নার কাজে এই পদ্ধতিই অধিক ব্যবহৃত হয়।


* ভাপে সিদ্ধ: পানি ফুটালে তা থেকে যে বাষ্প উঠে, সেই বাষ্পের উত্তাপে খাদ্যবস্তুকে সিদ্ধ করাকে ভাপে সিদ্ধ করা বলে। বিভিন্ন প্রকার পিঠা, বিশেষ করে ভাপা পিঠা, পুলি পিঠা, পুডিং, কাঁচা নুডল্স এভাবে ভাপে সিদ্ধ করে নেয়া হয়।


ভাপে সিদ্ধ করার জন্য হাঁড়ির অর্ধেক পরিমাণ পানি নিয়ে হাঁড়ির মুখ কাপড় দিয়ে ভালভাবে বাঁধতে হবে। হাঁড়ির পানি ফুটে বাষ্প উঠতে শুরু করলে কাপড়ের উপর খাবার দিয়ে ঢাকনা দিতে হবে। খাবার সিদ্ধ হওয়ার পরে ঢাকনা খুলে খাবার তুলে নিতে হবে। কাপড়ের পরিবর্তে হাঁড়ির মুখে ঝাঁঝরি বসিয়ে ভাপে সিদ্ধ করা যায়। ভাপা পিঠার জন্য বিশেষ রকমের মাটির হাঁটি পাওয়া যায়। গ্রামাঞ্চলে এক বিশেষ পদ্ধতিতে ভাঁপে সিদ্ধ করা হয়, এ ক্ষেত্রে বড় একটি হাঁড়িতে অল্প পরিমাণ পানি নিয়ে হাঁড়ির উপরের দিক খড় দিয়ে ভরা হয়। পানি ফুটলে খড়ের ভিতর দিয়ে বাষ্প উঠে আসে। তখন পিঠাগুলো খড়ের উপর বিছিয়ে দিলে বাষ্পের ভাপে সিদ্ধ হয়। 


ভাপে পুডিং জাতীয় খাবার তৈরির জন্য এ্যালুমিনিয়ামের সসপ্যানে পানি ফুটিয়ে পুডিং-এর মোল্ড বসানো হয়। মোল্ডের এক চতুর্থাংশ পানির নীচে থাকে। সসপ্যানে যদি পানি বেশি হয় তাহলে ফুটার সময় পানি মোল্ডের ভিতরে ঢুকতে পারে। যে পাত্রে পুডিং দেয়া হয় সে পাত্রের মাপ মতো ঢাকনা দিয়ে ঢাকলে পুডিং ভাল হবে। পুডিং-এর পাত্র না ঢেকে সসপ্যান ঢাকনা দিলে পুডিং-এ পানি পড়ার সম্ভাবনা থাকে।


* সেঁকা, টালা: তেল, পানি বা এজাতীয় কোন তরল উপকরণ ছাড়া খোলায় বা তাওয়ায় খাবার সেঁকে বা টেলে নেয়া যায়। যেমন-রুটি সেঁকা হয় কিন্তু জিরা, ধনে, শুটকী খোলায় টালা হয়। কাঁচা মাছ টেলে ভর্তা করা যায়। আবার মাটির পাত্রে বালু গরম করে তাতে মুড়ি ও খই টেলে ভাজা হয়।


* ভাজা: সিদ্ধ করা পদ্ধতির পরে খাবার তৈরির আর একটি অন্যতম পদ্ধতি হল ভাজা। খাবার অল্প তেলে এবং ডুবো তেলে দু'ভাবেই ভাজা হয়। মাছ, সবজি, পরোটা ইত্যাদি অল্প তেলে ভাজা যায়। ডুবো তেলে ভাজার জন্য কড়াইয়ে একবারেই বেশি তেল দিতে হবে। ভাজা শেষ হলে তেল ছেঁকে রান্নার জন্য রাখা যায়। ডুবো তেলে ভাজার জন্য তেল গরম করে ১৮০° সেঃ তাপে আনতে হবে। তেলের তাপ পরীক্ষা করার জন্য পাউরুটির কুচি বা শুকনা শাকপাতা তেলে ছাড়লে চারদিকে বুদবুদ উঠলে বুঝতে হবে ভাজার জন্য তাপ ঠিক আছে। তেলের তাপ সব সময় এক রকম রাখতে হবে। কম বা বেশি তাপ, এর দুটোতেই ভাজা ভাল হয় না। লুচি ডুবো তেলে অল্প ভাজতে হয়। কিন্তু সিঙ্গারা, ডালপুরী, সমুসা, পটেটো চিপ্স গরম তেলে বেশ কিছুক্ষণ না ভাজলে পরে নেতিয়ে যায়। চপ, কাটলেট টোস্টের গুঁড়ায় গড়িয়ে নিয়ে ডুবো তেলে ভাজতে হয়। প্রণ টেমপুরা, ফুলকো ইলিশ ইত্যাদি গোলানো ময়দায় ডুবিয়ে ভাজা হয়। ভাজার জন্য তেল খুব বেশি গরম করলে তেল থেকে ধোঁয়া বের হয়। এ-তেলে খাবার ভাজলে সে খাবার দেরিতে হজম হয়। তাই তেলে ভাজা খাবারকে গুরুপাক খাবার বলে। তেল থেকে যাতে ধোঁয়া না উঠে সেজন্য ভাজার সময় তেল ১৮০০ সেঃ তাপে রাখা দরকার। এতে ভাজাও সুন্দর হয়।


* ঝলসানো, পোড়ান: খাবার সরাসরি আগুনের উপর ধরে তাপ দেয়াকে পোড়ান বা ঝলসান বলে। মিষ্টি আলু, আলু, বেগুন আগুনে পুড়িয়ে নরম করা হয়। বেল, কাঁচা আম, কাঁচা তেঁতুল, জলপাই, ইত্যাদি কাঠকয়লার আগুনে পোড়ান যায়। শিক কাবাব, বোটি কাবাব, চিকেন টিক্কা ইত্যাদি কাঠ কয়লা অথবা বিদ্যুৎ অথবা গ্যাসের আগুনে ঝলসানো পদ্ধতিতে রান্না করা হয়।


* বেকিং: তন্দুর এবং ওভেনে খাবার বেক করা হয়। খাবার ওভেনে দেয়ার আগে ওভেন গরম করে নিতে হবে। তন্দুর বা ওভেনের মধ্যে খাবারের উপরে, নীচে এবং চারদিকে সমান তাপ পড়ে। পাউরুটি, কেক, বিস্কুট, পাই, পিজ্‌জা, পেস্ট্রি ওভেনে বেক করা হয়। মাছ, মাংস, সবজি, পুডিং, কাচ্চি বিরিয়ানী ইত্যাদিও ওভেনে রান্না করা যায়। ওভেনে মৃদু তাপে পোলাও, জর্দা, রেজালা দমে দেয়া যায়। বেকিং পদ্ধতিতে রান্নায় পরিশ্রম কম হয়।


সিদ্ধ, ভাজা, বেকিং, ঝলসানো রান্নার এসব মূল পদ্ধতিতে কতকগুলো কৌশল প্রয়োগ করে খাবারের ঘ্রাণ, স্বাদ, রং ও জমিনে বৈচিত্র আনা যায়। এই পদ্ধতিগুলো-


* স্টুয়িং (stewing): মাছ, মাংস, সবজি দুধ, পানি, সস বা এজাতীয় স্বল্প পরিমাণে কোর তরল দ্রব্য দিয়ে মৃদু আঁচে ঢেকে ধীরে ধীরে ফুটানোকেই বলে স্টুয়িং। বিফ স্টুও এই পদ্ধতিতেই রান্না হয়।


* ব্রেইজিং (braising): ঢাকনা দেয়া পাত্রে অল্পপরিমাণ তরল দ্রব্যের মধ্যে ধীরে ধীরে মৃদু আঁচে রান্না করাকে বলে ব্রেইজিং। মিটস্টক, পানি, দুধ, ক্রিম, সস এসব তরল দ্রব্য ব্যবহার করা যায়। ব্রেইজিং পদ্ধতিতে সাধারণত মাংস, মাছ রান্না করা হয়। মাংস প্রথমে সামান্য শুকনা ময়দা মাখিয়ে অল্প তেলে বাদামি রং করে ভেজে নিতে হবে। এরপর ঢেকে মৃদু আঁচে রাখতে হবে। মাঝে মাঝে কিছু তরল দ্রব্য দিয়ে উল্টে দিতে হবে।


* প্যান ব্রয়লিং (pan broiling): তাওয়ায় বা ফ্রাইপ্যানে না ঢেকে রান্না করাকে বলে প্যান ব্রয়লিং। এক্ষেত্রে রান্নার সময় কোন তরল দ্রব্য দেওয়া হয় না।


যেমন- বিফস্টেক, হ্যামবার্গার স্টেক।


* পোচিং ব্রয়লিং (poaching): খাবারের আকার নষ্ট না করে অল্প পরিমাণ গরম পানি, দুধ কিংবা তেলের মধ্যে ভাজা বা রান্না করাকে বলে পোচিং ব্রয়লিং।


যেমন-ডিম পোচ।


* গ্রীলিং (grilling): সরাসরি তাপ দিয়ে রান্নাকরার পদ্ধতিকে বলে গ্রীলিং। কেবলমাত্র উপর থেকে তাপ দিয়ে বা শুধু নীচ থেকে তাপ দিয়ে অথবা উপর নীচ দুদিক থেকে তাপ দিয়ে গ্রীল করা যায়। কম সময়ে রান্না করার জন্য এই পদ্ধতিতে উপযুক্ত। এক্ষেত্রে পানি বা কোন তরল দ্রব্য দেয়া হয় না। গ্রী করা খাবারের উপরিভাগ বাদামী রঙের ভাজা ঝলসানো মতো হলেও ভিত.. নরম থাকে।


উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়-গ্রীল চীজ, গ্রীল চিকেন।


* টোস্টিং (toasting): সরাসরি তাপ দিয়ে খাবারের বহিরাংশ বাদামী ও মচমচে করাকে বলে টোটিং। পাউরুটি টোস্ট করার পরে দু'পিঠ বাদামী ও মচমচে হয়।


* স্ক্যালোপিং (scalloping): টুকরা অথবা স্লাইস করা মাছ বা সবজির সঙ্গে দুধ কিংবা পানি বা সস মিশিয়ে স্তরে স্তরে বিস্কুটের গুঁড়া দিয়ে ১১। জয়ে বেক করে খাবার প্রস্তুতের নামই স্ক্যালোপিং। যেমন-স্ক্যালোপড পটেটো।


* বারবিকিউয়িং (barbequing): মাংস বা মাছে অল্প করে সস মাখিয়ে ধীরে ধীরে রোস্ট করা বা ঝলসানোকেই বলে বারবিকিউ। খাবারের উপরের অংশ শুকিয়ে যাতে শক্ত হয়ে বা পুড়ে না যায় সেজন্য মাঝে মাঝে বিশেষভাবে তৈরি বারবাকিউ সস মাখিয়ে দিতে হবে। যেমন- বারবাকিউ চিকেন।


* ক্যারামেলাইজিং (caramelizing): উনুনের উপরে বেশি তাপে সসপ্যান বা অন্য কোন পাত্রে চিনি গয়ের বাদামি রং করাকে বলে ক্যারামেলাইজিং। এভাবে গলানো বাদামি রঙের চিনিকে ক্যারামেল বলা হয়। খাবারের রং গাঢ় করতে ক্যারামেল ব্যাবহার করা হয়।


* গ্ল্যাসিং (glaceing): খাবারে চকচকে ভাব আনার জন্য খাবারে চিনির সিরার পাতলা আস্তরণ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলে গ্ল্যাসিং। নানরুটি, ডিনার ডোনাটে গ্ল্যাইস করা হয়।


* ডেমি গ্ল্যোইস (demi-glace): মাছ, মাংস রান্নার পর পানি শুকিয়ে গেলে বা ঘন হলে তেল বের হয়ে চকচকে দেখায়। খাবারের এই চকচকে ভাবকে ডেমি প্ল্যাইস বলা হয়।

No comments